বৃহস্পতিবার, ২৫ মে, ২০১৭

কুর’আনের অর্থ না বুঝার কারণে আপনি প্রতিদিন যে ১০টি জিনিস হারাচ্ছেন !

১-কুরআন নাযিলের উদ্দেশ্য বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছেন !

আপনি যদি কুর’আনের অর্থ না বুঝেই কেবল উচ্চারণ করে পড়তে থাকেন, তাহলে কুর’আন নাযিলের মূল উদ্দেশ্য হারিয়ে যাবে। আল্লাহ বলেন,
“এটি একটি বরকতময় কিতাব, যা আমি আপনার প্রতি বরকত হিসেবে অবতীর্ণ করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতসূহ লক্ষ্য করে এবং বুদ্ধিমানগণ যেন তা অনুধাবন করে”। সূরা সা’দ ২৯
কিভাবে এই উদ্দেশ্য আমাদের দ্বারা বাস্তবায়িত হবে যদি আমরা কুর’আন কি বলছে তা বুঝতে না পারি!
কোন ব্যক্তির পক্ষে কি সর্বদা অনুবাদ বহন করা সম্ভব, কিংবা সালাতে যখন কুর’আন তিলাওয়াত করা হয় তখন কি আমাদের পক্ষে কুর’আনের অনুবাদ বহন করা সম্ভব?.



২- আপনার মন হতে পারতো একটি সজ্জিত উদ্যান !


আমাদের মন যেন একটি সজ্জিত উদ্যান। আর সেই উদ্যানে যদি আমরা কোন গাছ না লাগাই, তাহলে সেখানে জন্মাবে আগাছা। এমনকি যদি আমরা ফুলের গাছ লাগাই, কিন্তু পরিচর্যা না করি তাহলেও সেখানে আগাছা জন্মাতে থাকবে। আমাদেরকে সর্বদাই আগাছা পরিষ্কার করতে হবে, কেবল তখনই আমরা আমাদের উদ্যানের সৌন্দর্য ধরে রাখতে পারব।
মনের ফুল হচ্ছে হেদায়াত,আল্লাহর বাণী,আল্লাহর দেখানো পথ, আর আগাছা হচ্ছে শয়তানের ওয়াসওয়াসা, কুচিন্তাসমূহ। প্রতিবার যখন আমরা কুর’আন তিলাওয়াত শুনি সালাতে কিংবা অন্যত্র তখন আমাদের মনে একটি ভালো অনুভূতি জন্ম নেয়, আমরা যদি সেই আয়াতসমূহের প্রতি মনোযোগ না দেই, কি বলা হচ্ছে তা বুঝার চেষ্টা না করি, আল্লাহর আয়াত-নিদর্শন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা না করি তাহলে তা হবে ফুল গাছ লাগানো বাগানে পানি না দেওয়ার মত, সেখানে জন্মাবে আগাছা আর সেই উদ্যান নষ্ট হয়ে যাবে।

৩- আপনি হারাচ্ছেন তিলাওয়াতের উদ্দেশ্য !

কুর’আন পাঠের পাঁচটি উদ্দেশ্য হতে পারে
১) আল্লাহর কাছ থেকে উপদেশ গ্রহণ
২) ইলম অর্জন
৩) আল্লাহ যা করতে বলছেন তা বাস্তবায়িত করা
৪) আমাদের মন ও অন্তরের আরোগ্য-শিফা
৫) আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সাথে কথোপকথন .
অর্থ না বুঝার কারণে আপনি এ সকল উদ্দেশ্য থেকে উপকার লাভ করতে ব্যর্থ হচ্ছেন।

৪-আপনি হারাচ্ছেন রুগ্ন ও ব্যধিগ্রস্ত অন্তর থেকে আরোগ্য লাভের সুযোগ !

আমরা সবাই জানি ফযরের সালাত আদায় করা ফরয। কিন্তু এরপরেও খুব অল্প কিছু মানুষ মসজিদের জামাতে অংশ নিতে সক্ষম হয়। কিন্তু কেন? এমন নয় যে, তারা এ বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নয়, মূল কারণ হচ্ছে আমাদের অন্তর রুগ্ন ও ব্যধিগ্রস্ত, মরিচা ধরা ।
অধিকাংশ লোকের একটি ভুল ধারণা হচ্ছে, কুর’আন শুধুমাত্র একটি আদেশ-নিষেধের কিতাব।
কি করা যাবে, আর কি করা যাবে না ; সে বিষয়ের কিতাব।
অথচ বিধি-নিষেধের আলোচনা করা হয়েছে এমন আয়াতের সংখ্যা মোট আয়াতের শতকরা ১০ ভাগেরও কম !
বাকি ৯০ ভাগেরও বেশি আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে এমন বিষয় সম্পর্কে যা আমাদের মন ও মস্তিষ্কের খোরাক, এগুলো আমাদের মনকে সতেজ ও পুষ্ট রাখে। আমাদের অন্তর দুর্বল ও রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে আমাদের পাপের কারণে। কাজেই এই মরিচা পড়া অন্তরে ঘষা মাজা এবং মজবুত করতে চাই কুর’আন।
আদম আলাইহি সালাম কে নিষেধ করা হয়েছিল তিনি যেন নিষিদ্ধ গাছের নিকটবর্তী না হন। আল্লাহ বলেন, “আমি ইতিপূর্বে আদমকে নির্দেশ দিয়েছিলাম। অতঃপর সে ভুলে গিয়েছিল এবং আমি তার মধ্যে দৃঢ়তা পাইনি”। ত্বহা ১১৫ । আমরা মানুষ, আর আমাদের রয়েছে নানাবিধ দুর্বলতা। আমাদের চারপাশে আছে নানা প্রলোভন ও পরীক্ষা। কাজেই এগুলো থেকে বাঁচতে আমাদের সদা সর্বদা তাযকিরাহ ( এমন উপদেশ যা আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়) ও সতর্কবাণী মনে রাখা প্রয়োজন, যা আমরা লাভ করতে পারি দৈনিক তিলাওয়াত এর মাধ্যমে।
আল্লাহ এ কারণেই বলছেন,
 “হে মানবকুল, তোমাদের কাছে উপদেশবানী এসেছে তোমাদের পরওয়ারদেগারের পক্ষ থেকে এবং অন্তরের রোগের নিরাময়, হেদায়েত ও রহমত মুসলমানদের জন্য”। [ইউনুস ৫৭]
“আমি কোরআনে এমন বিষয় নাযিল করি যা রোগের সুচিকিৎসা এবং মুমিনের জন্য রহমত…”।ইসরা ৮২
অন্তরের ব্যধি থেকে মুক্তির এর চেয়ে ভালো ঔষধ আর কে দিতে পারে, আল্লাহ ছাড়া?

– আপনি হারাচ্ছেন অন্তরে দৃঢ়তা লাভের সুযোগ !

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর কুর’আন একবারে নাযিল হয়নি, বরং তা ২৩ বছর সময় ধরে ধীরে ধীরে নাযিল হয়েছে।
 “সত্য প্রত্যাখানকারীরা বলে, তাঁর প্রতি সমগ্র কোরআন একদফায় অবতীর্ণ হল না কেন? আমি এমনিভাবে অবতীর্ণ করেছি এবং ক্রমে ক্রমে আবৃত্তি করেছি আপনার অন্তকরণকে মজবুত করার জন্যে”। ফুরকান ৩২
অন্তর দৃঢ়তা লাভ করে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি ও সতর্কতার খবর লাভ করে, ঈমান বৃদ্ধি পায়।
আল্লাহ বলেন,
“আর যখন কোন সূরা অবতীর্ণ হয়, তখন তাদের কেউ কেউ বলে, এ সূরা তোমাদের মধ্যেকার ঈমান কতটা বৃদ্ধি করলো? অতএব যারা ঈমানদার, এ সূরা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করেছে এবং তারা আনন্দিত হয়েছে”। তাওবা ১২৪
প্রতিদিন ধারাবাহিকভাবে সালাতে কিংবা কিরাতে অর্থ বুঝে কুর’আন তিলাওয়াত ও আল্লাহর আয়াতসমূহের উপর চিন্তা গবেষণা দ্বারা আমাদের অন্তর দৃঢ়তা লাভ করে। অর্থ বুঝে কুর’আন তিলাওয়াত না করে আপনি এ সু্যোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ।
৬-প্রতিদিন সালাতে আল্লাহর সাথে কথোপকথনের সুযোগ হারাচ্ছেন !
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুর’আনের আয়াতের সাথে যেন কথা বলতেন !
“আর যখন তিনি এমন আয়াত পড়তেন যেখানে আল্লাহর প্রশংসা করা হয়েছে, তিনি তাঁর প্রশংসা করতেন, আর যখন তিনি এমন আয়াত পাঠ করতেন যেখানে আল্লাহর কাছে কোন কিছু চাওয়ার কথা বলা হয়েছে, তিনি চাইতেন, আর যখন তিনি এমন কোন আয়াত পাঠ করতেন যেখানে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতে বলা হয়েছে, তিনি আল্লাহর আশ্রয় চাইতেন” [মুসলিম]
প্রিয় পাঠক ! ভেবে দেখুন, আমরা যখন আমাদের প্রিয়জনদের কাছাকাছি থাকি, তখন কি আমরা মিনিট পাঁচেকের জন্যেও কথা না বলে চুপ করে থাকতে পারি? আর আল্লাহর চেয়ে অধিক আপন আর কে হতে পারে?
তিনি আমাদেরকে আমাদের আপন মায়ের চেয়েও সত্তর গুণ বেশি ভালোবাসেন।
এরপরও আমরা জানার প্রয়োজন মনে করি না, আজকে সালাতে কি তিলাওয়াত করা হল!
আল্লাহ কি বিষয়ে কথা বলেছেন!
এমনকি কিছুমাত্র অর্থ না বুঝে আমরা কাটিয়ে দেই পুরো রামাদানের তারাবীহ’র সালাত !
৭-সরাসরি হেদায়াত ও পথ নির্দেশনা লাভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন !
আমরা যখন কুর’আন পাঠ করি কিংবা এর তিলাওয়াত শুনে থাকি তখন আমরা সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে দিক নির্দেশনা লাভ করতে পারি,পথ চলার বাতি লাভ করি। হেদায়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া এক অপূরণীয় ক্ষতি।
“এবং যে আমার স্মরণ (কুর’আন) থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, 
তার জীবিকা সংকীর্ণ হবে এবং আমি তাকে কেয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করব। 
সে বলবেঃ হে আমার পালনকর্তা আমাকে কেন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করলেন? আমি তো (দুনিয়াতে) চক্ষুমান ছিলাম।
আল্লাহ বলবেনঃ এমনিভাবে তোমার কাছে আমার আয়াতসমূহ এসেছিল, 
অতঃপর তুমি সেগুলো ভুলে গিয়েছিলে। তেমনিভাবে আজ তোমাকে ভুলে যাব”। ত্বহা ১২৪-১২৬
“…আমি আমার কাছ থেকে আপনাকে দান করেছি পড়ার গ্রন্থ। 
যে এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, সে কেয়ামতের দিন বোঝা বহন করবে”। ত্বহা ৯৯-১০০



-আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন !

আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের বিভিন্ন মাত্রা রয়েছে- তাঁর প্রতি ভালোবাসা, আন্তরিকতা, তাঁর উপর ভরসা করা, আল্লাহকে স্মরণ করা সরাসরি কিংবা যখন আমরা তাঁর কোন আয়াত তথা সৃষ্টি নিদর্শন দেখতে পাই, তাঁর সৃষ্টিকে নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা, তাঁর গুণবাচক উত্তম নামসমূহ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ ইত্যাদি নানাবিধ বিষয় রয়েছে। এই সম্পর্ক কেবল সময়ের সাথে সাথে আরও ঘনিষ্ঠ হয়। আর এজন্য প্রয়োজন অল্প করে হলেও ধারাবাহিকতা বজায় রেখে দৈনন্দিন কিছু না কিছু আল্লাহর কালামের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা।

– আপনার চরিত্র হতে পারতো আল-কুরআন এর মত 

আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, “কুর’আনই হল আল্লাহর রাসূল(সা) এর আখলাক”
কুর’আন যদি হয় তত্ত্বকথা (থিওরি) তাহলে তার ব্যবহারিক হাতে কলমে প্রদর্শনী দিয়েছেন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সমগ্র জীবনের মাধ্যমে। আমাদের উচিত নবীজী(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের) জীবনীগ্রন্থ পাঠ করা এবং সেই ঘটনাপ্রবাহের সাথে আয়াতসমূহের মিল খুঁজে বের করা।
যেমন, হিজরতের সময় আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একান্ত মনে নিবিষ্ট চিত্তে, নির্ভাবনায় সাথে পাঠ করে যাচ্ছিলেন একটি আয়াত, অপরদিকে সাথী আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন সংগীর নিরাপত্তা চিন্তায় উদ্বিগ্ন। সেটি হল,
 “…হে আমার রব! (আমাকে যেখানেই নিয়ে যাও না কেন) তুমি আমাকে সত্যের সাথে নিয়ে যেও এবং (যেখান থেকেই আমাকে বের করো না কেন) সত্যের সাথেই বের করো এবং দান করো আমাকে তোমার কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় সাহায্য”। [ইসরা ৮০]

১০- কুরআনের চোখে বিশ্ব দেখার সুযোগ হারাচ্ছেন !

এ পৃথিবী একটি মায়ার জগত, যেন এক মস্ত কুহেলিকা আর ধোঁকা, যার অন্তরে কুর’আন নেই তার অন্তর একটি শূণ্য ঘরের মত যে ঘরে কোন আসবাব নেই। কুর’আনের শিক্ষা না থাকার কারণে সে দুনিয়ার জগতকেই বড় ও আসল বলে মনে করে, ফলে সে পরকালের প্রতি হয়ে পড়ে উদাসীন। এরূপ ব্যক্তির জীবন যতই সুখকর হোক না কেন তা শুধুই স্বপ্নের মত, যা ঘুম ভেঙ্গে গেলে হারিয়ে যায়।
যখন একজন ডাক্তারের কাছে এসে কোন রোগী নিজের সমস্যা ও অসুস্থতার বর্ণনা দিতে থাকে তখন অভিজ্ঞ ডাক্তার সেই লক্ষণসমূহ শুনতে থাকেন এবং রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করেন, পরিশেষে তিনি নিরাময়ের জন্য ঔষধ কিংবা পরামর্শ দান করেন। একইভাবে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা নানা বিচিত্র ঘটনার সামনে এসে দাঁড়াই।
আমাদের উচিত আমরা যেন সেই সমস্যাগুলোর সমাধান আল্লাহর কালামের কাছ থেকে নেয়ার মত সক্ষমতা অর্জন করি। এটা কেবল তখনই সম্ভব হবে, যখন আমরা নিয়মিতভাবে কুর’আনের অর্থ শিক্ষা লাভ করব এবং সেই শিক্ষার সাথে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের পরিস্থিতির মিল খুঁজে বের করতে পারব।

Read More »

সোমবার, ১৫ মে, ২০১৭

বাতিঘর

কোণাচোখে তারিককে পাশের টেবিলে আরাম করে বসতে দেখে জামিল দ্রুত গলা নামিয়ে বলে, ‘শুনুন, আপনি কিন্তু কিছুতেই আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবেননা’।
ঘটনার আকস্মিকতায় থতমত খেয়ে যায় ফারজানা। সে লোকটাকে চেনেনা, জানেনা, কোন সালাম নেই, সম্ভাষন নেই, হুট করে এই আচমকা অনুরোধ! তারিকের দিকে জামিলের চোরা চাহনি, ফিসফিস কথা বলার ভঙ্গি আর এই অদ্ভুত প্রস্তাব- সব মিলিয়ে কিম্ভুত এই পরিস্থিতিতে হঠাৎ হাসি পেয়ে যায় ওর। হাসি চাপার চেষ্টা করতে করতে সে স্মিত হেসে বলে, ‘আসসালামু আলাইকুম’।
এবার নিজের অভদ্র আচরন স্মরন করে জামিল নিজেই একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে, লজ্জা লজ্জা চেহারায় টেবিলের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ওয়া আলাইকুম আসসালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’।
‘আমার নাম ফারজানা’।
‘জ্বি, তারিক ভাই এইমাত্র বললেন। আমি জামিল’।
‘আপনার মত আমিও আসলে এখন বিয়ে করতে উৎসাহী নই। কিন্তু আমি যদি এই মূহূর্তে উঠে চলে যাই তাহলে বিয়ে করবনা বললে ভাইয়া কিছুতেই কনভিন্সড হবেনা। সুতরাং, আমাদের মনে হয় কিছুক্ষণ অন্তত কথা বলার অভিনয় করা উচিত’।

জামিল বুঝতে পারল কথায় যুক্তি আছে, কিন্তু সে কি বলবে? ওর তো এটুকুই শুধু বলার ছিল!
ফারজানাই এগিয়ে এলো, ‘আচ্ছা, আপনি বিয়ে করতে না চাইলে দেখা করতে চাইলেন কেন? আপনি তো মেয়ে না যে কেউ আপনাকে জোর করে বাধ্য করতে পারবে!’
জামিল ওর দিকে তাকালে দেখতে পেত ওর চোখের তারায় কৌতুক, কিন্তু টেবিলের দিকে তাকিয়ে থাকায় সে ফারজানার কথায় দুষ্টুমির ভাবটা ধরতে পারলনা। খুব অপরাধী, মাটির সাথে মিশে যেতে পারলে বাঁচে এমন চেহারা করে আমতা আমতা করে বলতে লাগল, ‘আসলে আমার বাবামা ভাইবোন কেউ নেই। চাচা চাচীর কাছে মানুষ। এখন শহরে থাকি বলে তাঁদের সাথেও তেমন যোগাযোগ হয়না। একা থাকি বলে তাঁদের চিন্তার অন্ত নেই। চাচা তাঁর এক বন্ধুকে বললেন আমার জন্য মেয়ে দেখতে। আমার নিজের কোন কুলকিনারা নেই, সাধারন একটা পেটেভাতে চাকরী করি, ছোট্ট একটা দু’কামরার ঘরে ভাড়া থাকি- এই জীবনে কাউকে জড়িয়ে কষ্টে ফেলে লাভ আছে? কিন্তু চাচা চাচী কিছুতেই বুঝতে চান না। চাচার এক বন্ধু আপনার ভাইকে চেনেন। ওঁরা আমাকে এমনভাবে ধরলেন যে মেয়ে না দেখে কোন সিদ্ধান্তই তারা শুনবেন না। তাই আপনাকে কষ্ট দিতে হোল। আপনাকে এখানে আসতে বাধ্য করা হয়ে থাকলে সেজন্য আমি অত্যন্ত দুঃখিত। প্লীজ আমাকে মাফ করে দেবেন’।
জামিলের হাবভাবে এবার ফারজানা কিছুতেই হাসি চেপে রাখতে পারলনা, খিক করে একটু হাসি দিয়েই মুখে হাত চেপে ধরল। এবার জামিল থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘আমি কি এমন কিছু বলেছি যা আপনার অস্বাভাবিক মনে হয়েছে?’ ফারজানা হাসি সংযত করার চেষ্টা করে বলে, ‘নাহ, তবে আপনার চেহারায় কেমন যেন একটা চোর চোর মার্কা দুঃখী দুঃখী ভাব আছে, হি হি…’
‘চোর চোর?’, কনফিউজড হয়ে যায় জামিল।
‘জ্বি, আদিব, আমার ভাইয়ের ছেলেটা বিস্কিট চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলে যেমন চেহারা বানায় আপনার চেহারাটা ঠিক তেমন লাগছে, হি হি হি…’
এবার জামিলও হেসে ফেলে।
‘আচ্ছা, আপনি কি নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়েন?’
অপ্রত্যাশিত প্রসঙ্গ পরিবর্তনে আবার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় জামিল, শুধু উত্তর দিতে পারে, ‘জ্বি’।
‘আপনি কি লেখাপড়া করতে পছন্দ করেন? যেমন কুর’আন হাদিস পড়া, গল্পের বই পড়া, বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা ইত্যাদি?’
‘জ্বি, নিয়মিত পড়ি’।
‘আপনি কি সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বাস করেন?’
‘জ্বি’, কথাবার্তা যে কোনদিকে যাচ্ছে কিছুই ঠাহর করতে পারেনা জামিল।
‘আপনি কি বিশ্বাস করেন যে সৃষ্টিকর্তা আপনাকে কোন বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন এবং তিনিই আপনাকে সেই উদ্দেশ্যের কাছে পৌঁছে দেবেন?’
‘জ্বি’।
‘তাহলে আপনার কি মনে হয় আপনার কথায় এই বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়? নাকি আপনার মন বিশ্বাসের কথা বললেও মুখ অবিশ্বাসের সাক্ষ্য দেয়?’

বাক্যালাপ এখানে এসে ঠেকবে স্বপ্নেও কল্পনা করেনি জামিল। কিন্তু এই অপরিচিত মেয়েটি তাকে এমন এক রূঢ় সত্যের সম্মুখীন করে দিয়েছে যা সে কখনো ভেবেও দেখেনি। সময় তাকে এমন এক ব্যাক্তিতে রূপান্তরিত করে দিয়েছে যে বিশ্বাসের কথা বলে অথচ নিরাশায় ভোগে, যে আত্মীয়তার জন্য হাহাকার করে অথচ আত্মীয়তার বন্ধনের মূল্যায়ন করতে পারেনা, যে আল্লাহর ওপর নির্ভরতার কথা বলে অথচ কারো দায়িত্ব নেয়ার জন্য নিজেকে নির্ভরযোগ্য মনে করেনা। হা করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোন জবাব দিতে পারেনা সে।
ওদিকে তারিক উঠে দাঁড়ায়, ফারজানাও সালাম দিয়ে ভাইকে অনুসরন করে। তারিক আর ফারজানাকে বিদায় দিয়ে আবার রেস্টুরেন্টের বে-আরাম চেয়ারটাতে বসে ভাবতে থাকে জামিল, মেয়েটা তাকে কি বলে গেল?

দু’ঘন্টা পর, ফারজানার বাসায়ঃ 

‘অ্যাই বলনা ছেলেটা দেখতে কেমন ছিল?’
‘সত্যি ভাবী, আমি খেয়াল করিনি। খুব বেশি খারাপ হলে হয়ত খেয়াল করতাম’।
‘তাহলে আমার যে ননদিনি এতদিন বিয়ে করতে রাজী হয়নি সে কি দেখে একঘণ্টায় বিয়ে করতে রাজী হয়ে গেল?’
‘ওহ, তুমি এটা জানতে চাও? বললেই তো হত!’, চোখ টিপে হেসে ফেলে ফারজানা।
‘জ্বি ফারজু বিবি, এটাই জানতে চাই’, গালে হাত দিয়ে কৌতুহল প্রকাশ করেন ভাবী।
‘শোন তাহলে- লোকটাকে দেখে মনে হোল আমি এই লোকটার জীবনে কিছু একটা অবদান রাখতে পারব, তার বিশ্বাসকে পূর্ণতা দান করতে সাহায্য করতে পারব, তার সাথী হতে পারব। অধিকাংশ পুরুষ বিয়ে করার সময় কাজের মেয়ে খোঁজে। ভাবী, আমার ঘরের কাজ আমি করব, তাতে আপত্তির কি আছে? কিন্তু সেটাই যদি বিয়ের একমাত্র উদ্দেশ্য হয় সেটা আমি মেনে নিতে পারিনা’।
‘তা তো ঠিক আছে ফারজু বিবি। কিন্তু তোমার ভাইয়া বলল ছেলেটাকে দেখে বিয়ের ব্যাপারে আগ্রহী মনে হয়নি, আমি ভাবছি তুমি তার জীবনে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে তা সে মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে কিনা’, চিন্তিত মনে হয় ভাবীকে।
‘ভাবী, লোকটাকে দেখে মনে হোল খুব সরল আর লাজুক প্রকৃতির কিন্তু বোকা না। উনি নানা কারণে জীবনের প্রতি আশাহত কিন্ত এই আশা জাগিয়ে তোলার মত বিশ্বাস ওনার মনের কোণে কোথাও অবশিষ্ট আছে’।
‘তাহলে আশা করি তুমি তার সেই ভঙ্গুর আশালতায় কোথাও দোলা দিতে পেরেছ’, ফারজানার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকান ভাবী। বাপমা মরা এই মেয়েটাকে নিজের মেয়ের মত করেই বড় করেছে তিনি। কোনদিন ওর বিশ্বাসে এতটুকু চির ধরতে দেননি। এই আশার উজ্জ্বল প্রদীপ, এই বাতিঘর যদি সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া কোন নাবিককে পথ দেখাতে পারে, পারে আরেকটি ঘরকে আলোকিত করতে, তবে এর চেয়ে বেশি আর কি সাফল্য আশা করতে পারেন তিনি?

তিনদিন পর, নদীর ধারেঃ 

‘মেয়েটা যে তোর জন্য perfect তা কি এখন তোর মাথায় ঢুকেছে না আরো সময় লাগবে?’, রোদের জন্য ভ্রূ কুঁচকে জামিলের দিকে তাকানোর চেষ্টা করে কামাল। জামিলের মুখটা ভারী উজ্জ্বল দেখাচ্ছে, ওটা কি রোদের আলো না আশার?
‘হিসেব করছি রে দোস্ত। কথায় কথায় ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদবে, বাচ্চাদের মত আবদার করে জীবন অতিষ্ঠ করে তুলবে এমন বৌয়ের ভীতি থেকেই বিয়ে করতে অনীহা বোধ করতাম। কিন্তু এই মেয়েটা প্র্যাক্টিকাল, সেন্সিবল, স্মার্ট, বুদ্ধিমতি এবং ঠিক আমার মত পরিস্থিতিতে বড় হয়েও ওর বিশ্বাসটা অত্যন্ত মজবুত। আমার জীবনের এক বিরাট সত্য সে আমাকে কি অবলীলায় বুঝিয়ে দিল মনে একটুও কষ্ট না দিয়ে! এই সাহচর্য আমার প্রয়োজন, ম্যাগ্নিফায়িং গ্লাস দিয়ে দুঃখগুলোকে দেখা বন্ধ করার জন্য ওর হাসির জোয়ার আমার জীবনে দরকার, সবচেয়ে বড় কথা ওর বিশ্বাসের শক্ত খুঁটিটা হতে পারে আমার জীবনের সে অবলম্বন যা আমি এতদিন খুঁজে খুঁজে হয়রান হচ্ছি’।
‘তাহলে তুই দেরি করছিস কিসের জন্য?’
‘মেয়েটা যে বলল সে বিয়ে করতে আগ্রহী না!’
‘তুই জিজ্ঞেস করেছিলি, কেন?’
‘নাহ’।
‘গাধা কোথাকার! জিজ্ঞেস করবিনা?’, ঈষৎ বিরক্ত হয় কামাল, পরক্ষণেই আবার আশাবাদী হয়ে ওঠে, ‘যাক, সে বুদ্ধিমতি মেয়ে, ঠিকই বুঝতে পারবে তোর জীবনে সে ফ্রেন্ড, গাইড অ্যান্ড ফিলোসফার হয়ে বিরাজ করতে পারবে। একজন বুদ্ধিমতি মেয়ের জন্য এটাই বড় প্রাপ্তি’।
‘কিন্তু ওর আমাকে পছন্দ হোল কি’না কিভাবে জানব?’
‘ওরে দোস্ত, ওর পরিবারের সাথে কথা বল, নাহলে জানবি কি করে?’
‘ওঁরা যদি না করে দেয়?’
‘হ্যাঁও তো বলতে পারে। তুই আগেই নিরাশ হলে মেয়েটা তোকে শেখালটা কি?’
মাথা নাড়ে জামিল, আজই কথা বলতে হবে।
‘তা মেয়েটা দেখতে কেমন রে?’
‘খেয়াল করিনি তো!’, নিজেই অবাক হয় জামিল, ‘কিন্তু খুব বেশি খারাপ না মনে হয়, তাহলে হয়ত খেয়াল করতাম’।
খুশি হয় কামাল, ‘যারা মানুষের অন্তর দেখে পছন্দ করে তারাই মেয়ে দেখে এসে বলতে পারে চেহারা খেয়াল করেনি। এই বিয়ে হলে তুই ঠকবি না দোস্ত’।
উঠে দাঁড়ায় দু’জনে, আনন্দের আতিশয্যে হঠাৎ স্লোগান ছাড়ে কামাল, ‘জামিল তুই এগিয়ে চল, আমরা আছি তোর সাথে’।
হো হো করে হেসে ফেলে দু’জনে।

ছয়মাস পরঃ 

‘আজকে তোমার নতুন চাকরী, এত সুন্দর জামাকাপড় পরেছ অথচ চুলটা আঁচড়াওনি। একটু গেলাম রান্নাঘরে আর ব্যাস, তোমার ফাঁকিঝুঁকি শুরু! তোমাকে নিয়ে আমি কি করি বলত?’, ব্যাস্তসমস্ত হয়ে পাশের রুম থেকে চিরুনী হাতে দৌড়ে আসে ফারজানা।
টেবিলে ঠান্ডা হতে দিয়ে যাওয়া খাবারগুলো টিফিন ক্যারিয়ারে ভরতে ভরতে জামিল বলে, ‘আমি চুল আঁচড়ালে সকাবেলা আমার মাথায় তোমার হাতের স্পর্শ নিয়ে বেরোব কি করে বলত? তুমি সকালে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিলে আমার সারাদিন মাথা ঠান্ডা থাকে, একদম যেন তিব্বত কদুর তেলের বিজ্ঞাপনের মত!’
‘হি হি হি’, ওকে হাসতে দেখে জামিলের হাসিটাও ঠোঁটের একপাশ থেকে পুরো মুখে ছড়িয়ে পড়ে। জামিলকে শেষপর্যন্ত হাসতে শেখাতে পেরেছে ফারজানা, ওর দুষ্টুমিগুলো এখন সে কিছু কিছু বোঝে, নিজেও দুষ্টুমি করতে শুরু করেছে দেখে বেশ উৎফুল্ল হয় সে।
‘যাবার পথে চাচা চাচীকে ফোন করে জানিয়ো নতুন চাকরিতে যাচ্ছ’।
‘ওঁরা জানেন তো’।
‘তাতে কি হয়েছে? ফোন করে জানাও, খুশি হবেন। আর বিকালে ফিরলে চাচীর জন্য শাড়ি কিনব যেন আগামী বৃহস্পতিবার নিয়ে যেতে পারি। আগামী মাসে বেতন পেলে চাচাকে পাঞ্জাবী কিনে দেব’।
‘আর তুমি কি কিনবে?’

‘বাহ, তোমার মতন এমন একটা চমৎকার গিফট থাকতে আমার আর কি লাগবে?’
মনে মনে একই কথা ভাবে জামিল, কিন্তু ওর মত সাবলীলভাবে বলতে পারেনা। বেহেস্তের টুকরোর মত বৌটার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে।
‘তুমি কি চাও তোমার নতুন অফিসে প্রথমদিন লেট হোক?’
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে জুতো পায়ে দিতে দিতে আবার ফারজানার দিকে তাকায় জামিল।
‘যাআআআও’, বলে হাতে টিফিন ক্যারিয়ারটা হাতে গুঁজে দিয়ে দরজা খুলে ওকে প্রায় ঠেলে বের করে দেয় ফারজানা।
শেষ একবার পেছন ফিরে তাকালে ফারজানা মিষ্টি হেসে বলে, ‘আসসালামু আলাইকুম’।
এই স্বর্গীয় সম্ভাষন কানে নিয়েই প্রতিদিন পৃথিবীর বন্ধুর পথে যাত্রা শুরু হয় জামিলের, সে স্মিত হেসে জবাব দেয়, ‘ওয়া আলাইকুম আসসালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’।
এখনো রিক্সা পেতে দেরী হয়, বাসে ভিড় ঠেলে উঠতে কষ্ট হয়, অফিসে ঝামেলা হয়, দোকানে দরদাম নিয়ে মন কষাকষি হয়, দু’কামরার ঘরটাতে চাপাচাপি হয়, কোন কোনদিন ভাল তরকারীও থাকেনা। তবু কেন যেন পৃথিবীটাকে আর আগের মত জটিল মনে হয়না। দিনের শেষে ওর জীবনে আছে এমন এক সাথী যে ওর সুখদুঃখ সব সমানভাবে ভাগাভাগি করে নেয়, যে ওর কষ্টগুলোকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতে পারে, যে ওর বিশ্বাসকে এক আলোর তৈরী মিনারের মত উচ্চকিত করে তোলে। হাসি পায় এই ভেবে যে এই দুই শ্রেষ্ঠ বন্ধুর প্রথম বাক্যালাপ ছিল, ‘আপনি কিন্তু কিছুতেই আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবেননা’!

Read More »

শুক্রবার, ৫ মে, ২০১৭

খাদ্য অপচয়

২০০৫ সালের কথা। দীপালিদের বাসায় নিয়ম ছিল যে সে খাবে রাতের ভাত, আর দুপুরে খাবে তারভাই। এই নিয়মের পিছনে জিরো ফিগারের বাসনা না – ছিল তার বাবার চাল কেনারঅক্ষমতা। একদিন সন্ধ্যায় দীপালীর ভাই এমনই ক্ষুধার্ত ছিল যে সে তার বোনেররাতের ভাগটুকু খেয়ে নেয়। প্রায় ২৪ ঘন্টার অভুক্ত দীপালি যখন দেখে তারভাত তার আপন ভাই চুরি করেছে তখন অভিমানে তার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। আরকোনদিন যেন বাবা-মার কাছে ভাত না চাইতে হয়, তাই সে কন্ঠে কাপড় জড়িয়েঝুলে পড়ে। জীবনের মত সে তার ভাগের ভাতটা ভাইকে দিয়ে যায়।
আমরা জানি আত্মহত্যা মহাপাপ। তবে আমরা এটা জানিনা যে আজ রাতে আমাদের হাঁড়িধোয়ার সময় যে ভাতগুলো ফেলে দেয়া হবে তাতে দীপালির ভাগ ছিল। যতই জনসংখ্যাবাড়ুক, এই দুনিয়াতে আল্লাহ যত মুখ সৃষ্টি করেছেন তাদের সবার খাবারেরভাগও তিনি রেখেছেন। যখন কেউ কারো মুখের গ্রাস কেড়ে নেয় তখন মানুষঅনাহারে আত্মহত্যা করে। গরীব মানুষের মুখের গ্রাস শুধু মাল্টি ন্যাশনালকোম্পানিগুলো একা কেড়ে নেয়না, আমরাও নেই।

রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন তোমরা বেশী খেওনা। যদি খাও তবে অপর ভাইয়ের ভাগ খেয়ে ফেলতে পার। আমরা শুধুই যে বেশী খাই তা নয়, বেশী খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে উচ্ছিষ্টাংশটি ডাস্টবিনের কুকুরদের সমর্পণ করি। চারপেয়ে এবং দু’পেয়ে কুকুর। বাংলাদেশে বিয়ে বাড়িতে মোচ্ছব চলেপ্লেট ভর্তি করার। পিজা হাট অফার দেয় – এস কত খেতে পার। সিয়াম মানে সংযমকে বলেছে? সিয়াম মানে রাক্ষসের মত খাওয়া, যত বেশী খাওয়া যাবে ততই লাভ। সারা বছরে মাত্র একবার পিজা হাট ইসলামের শিক্ষাকে বুড়ো আঙুল দেখায় – সেটা রমাদান মাসে। সিয়াম মানে সংযম কে বলেছে? যিনি দশ পদের কমে ইফতার করেননা তিনি? আমেরিকায় দেখেছি মসজিদ মসজিদে মুফতে ইফতার দেয়। মানুষ ডিসপোজ্যাবল প্লেট ভরে খাবার নেয়, কিছুটা খায়, কিছুটা ছড়ায় তারপরে প্লেট ভাজ করে ট্র্যাশে ফেলে দেয়। বিরিয়ানি ভর্তি প্লেট। রুটি-মাংশ ভর্তি প্লেট। নাশপাতি-আঙুর-খেজুর ভর্তি প্লেট। বাবা-ছেলে পাশাপাশি বসে একই কাজ করে। ফেলেদেয়ার আগে একটুও হাত কাঁপেনা। মাথায় একটুও আসেনা যে সোমালিয়াতে সেইমূহুর্তে মানুষ ইফতার করছে শুধু বাতাস দিয়ে। সৌদি আলিমদের কাছে ফতোয়াজানতে চাচ্ছে – তাদের সেহরিতে খাবার কিছু নেই, ইফতারেও কিছু জোটেনা; তাদেররোজা হবে তো? সৌদি মুফতি উত্তর দিতে পারেননি, ঝরঝর করে কেঁদেছেন। আমরা কেউ প্রশ্নটা শুনতে পাইনি। আমরা তখন খেতে ব্যস্ত ছিলাম।
পৃথিবী কত বদলে যায়। এইতো বছর পঞ্চাশেক আগেও সোমালিয়াকে বলা হত আফ্রিকার রুটির ঝুড়ি। সেই সবুজ আজ কোথায় হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে গরু-ছাগলের পাল। মানুষের পাল এখন খোঁয়ারে থাকে। আইএমএফ দয়া আর মমতার বাঁধনে বেঁধে রেখেছে ওদের। ভালবেসে ঋণ দিয়েছে। তারপর বাতলে দিয়েছে ঋণ শোধের উপায়। এই বাঁধনকি আর ছেড়া যায়? বিজ্ঞানীরা বলবেন ক্লাইমেট চেঞ্জ – জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণেই নাকি এ দুর্ভিক্ষ। পশ্চিমা মিডিয়া বলবে আল-শাবাব মুসলিম চরমপন্থীদের জন্যই আজ এই দশা। খিলাফাতওয়ালারা বলবে তাগুতের তাবেদার সরকারের দোষ। আমি কিছু বলবনা। আমার চোখে ভাসতে থাকবে বিশাল সব ট্র্যাশব্যাগ। কালো কালো ট্র্যাশব্যাগ। একটা ব্যাগে যে পরিমাণ খাবার ফেলে দেয়া হয়েছে তাতে একটা গ্রামের সবগুলো ক্ষুধার্ত মানুষ পেটপুরে খেতে পারত।
শস্য-শ্যামলা-সুজলা বাংলাদেশে এখন জল নেই। আমনের মৌসুমে যেখানে খেত জলে থই থই করে সেখানে এখনপাম্প বসিয়ে সেচ দিতে হয়। ডীপ টিউবওয়েল। পানির স্তর নেমে গেছে বহু দূর, আশি ফুট গভীরতাতেও কাজ চলে না। আমেরিকায় চলছে পঞ্চাশ বছরের সবচে ভয়াবহ খরা। তবু আমাদের বুক কাঁপেনা। ভাবখানা এমন যেন আল্লাহর সাথে পানিচুক্তি করাআছে। অথচ আল্লাহ বলছেন নেই। মহান আল্লাহ হুমকি দিলেন সুরা মুলকের শেষে – তিনি যদি পানির স্তর নামিয়ে নেন তাহলে ভূ-পৃষ্ঠে কে দেবে পানি?
আমরা এই হুমকির থোড়াই কেয়ার করি।
আল্লাহ আল কুরআনের দুই জায়গাতে বলেছেন, তোমরা অপচয় করোনা, আল্লাহ অপচয়কারীকে ভালবাসেননা। আমরা আল্লাহর ভালোবাসার থোড়াই কেয়ার করি। নানান জাতের ভালোবাসাতে ভর্তি হয়ে আছে টিভি। আল্লাহর ভালোবাসা না দেখা যায়, না বেচাযায়। এ ভালোবাসা দিয়ে কি করব?
রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন কারো কাছ থেকে মাটিতে খাবার পড়ে গেলে সে যেন সেটা তুলে, ধুলোটা ঝেড়ে খেয়ে ফেলে; শয়তানের জন্য রেখে না দেয়। তিনি খাবার পরে হাত চেটে খেতে বলেছেন, কারণ খাবারের কোন অংশে বারাকাত আছে সেটা মানুষ জানেনা। আমাদের যে টেবিল ভদ্রতা শেখান হয় তাতে পতিত খাবার অচ্ছুত ময়লা, তুলে খাওয়া তো দূরে থাক সেটা স্পর্শই করা যাবেনা। কাজের মানুষেরা পরে ঝাড়ু দিয়ে সেটা ফেলে দেবে। হাতের আঙুল বা থালা মুছে খাওয়াতো নিতান্ত অসৌজন্যতা। ইহুদিরা জেরুজালেমে মুসলিমদের হারিয়ে দিয়েছে বলেআমরা হায় হায় করি। আর এদিকে আমরা নিজেরা নিজেদের ডাইনিং টেবলে ইসলামকে হারিয়ে দিয়েছি। শয়তান এখন আর আমাদের শত্রু না – বন্ধু। তাকে আসন পেতেদেই খেতে। পেট ভরার পরে বাকি খাবারটা তার জন্য বরাদ্দ করে রাখি। আর বারাকাত দিয়ে আমরা কি করব? বারাকাত কমছে বলেই খাবারে বিষ দেয়া হচ্ছে, লাফিয়ে লাফিয়ে খাবারের দাম বাড়ছে, খাবারের স্বাদ-তৃপ্তি সব উধাও হয়ে যাচ্ছে। আপন হাতে কল্যাণের দরজা বন্ধ করে রেখে অন্যকে দুষে কি লাভ?
ইসলামের কথা বাদ দেই, খাবার নষ্ট মানে তো কৃষককে অপমান করা। তার শ্রম, তারকষ্টটাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা। আমরা শহুরে মানুষ; একগোছা ধান ফলাতে কি কষ্টআমরা কি করে বুঝব? আমাদের কাছে পাতে ফেলে রাখা এক মুঠ ভাতের দাম কয়েকপয়সা মাত্র – এর চেয়ে বেশী কিছু তো নয়। রান্না করা খাবার ফেলে দেয়া মানে সেই মানুষটার প্রতি অশ্রদ্ধা যে কষ্ট করে খাবারটা রান্না করল চুলার আঁচ সহ্য করে। সেই মানুষটার প্রতি অসম্মান যে কষ্ট করে খাবারটা বয়ে নিয়ে আসল বাজার থেকে। আমরা বুদ্ধিজীবি মানুষ। কাজের মানুষদের সময় আর শ্রম কিনে নিয়েছি কয়েক টাকায়। টাকা দিয়ে সব কিছু শোধ করা যায়না – এটা আমরা বুঝতে চাইনা।
পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট মানুষ ছিলেন রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। মদিনাতে হিজরত করার পরথেকে তারমৃত্যু অবধি তার পরিবার পরপর তিনদিন পেটপুরে খেতে পারেনি। সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী মানুষদের এমন সময়ের মধ্যে যেতে হয়েছে যখন হাবালা গাছের পাতা ছাড়া তাদের আর কোন খাবার ছিলনা। তাদের মল আর ভেড়ার মলের কোন পার্থক্য ছিলনা।৩ আমাদের আল্লাহ খাবারের যে প্রাচুর্য দিয়েছেন সেটাকে আল্লাহর নিয়ামাত বলে আমরা ভাবতে ভালবাসি; ভুলেও চিন্তা করিনা এটা আল্লাহর পরীক্ষাও বটে। আমরা আমাদের প্রতিদিনের জীবনে খাবার নষ্টের মাধ্যমে আল্লাহর অকৃতজ্ঞতা করছি। শাস্তি হিসেবে ক্ষুধাকে চেয়ে নিচ্ছি।

ভাই, আপনি যদি কুরআনকে আল্লাহর বাণী বলে বিশ্বাস করে থাকেন তাহলে এরপর যখন আপনি থালায় একটিও ভাত রেখে উঠে যাবেন তখন মনে রেখেন – ইন্নাহু লাইয়ুহিব্বুল মুসরিফিন – নিশ্চয় আল্লাহ অপচয়কারীকে ভালবাসেননা। বোন, আপনি যখন আপনার সন্তানের উচ্ছিষ্ট খাবারটি ফেলে দিচ্ছেন তখন মনে রেখেন – ইন্নাহুলা ইয়ুহিব্বুল মুসরিফিন। বেগুনের এক কোণে একটু দাগ থাকার কারণে যখনপুরোটা ছুড়ে ফেলে দিচ্ছেন তখন মনে রেখেন – ইন্নাহু লা ইয়ুহিব্বুল মুসরিফিন।
পৃথিবীর মানুষের ভালবাসা না পেলেও জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়; পৃথিবীর রব্ব আল্লাহর ভালবাসা না পেলে ধ্বংস অনিবার্য। আল্লাহ যেন আমাদের মুসরিফিন হবার হাত থেকে রক্ষা করেন। খাবারনষ্ট করা যাবেনা এটা যেন আল্লাহ আমাদের মননে-জীবনে গেঁথে দেন।

Read More »

মঙ্গলবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৭

পবিত্র কোরআন ও বিজ্ঞান

বিজ্ঞান নের ও অনেক অনেক বড় বিজ্ঞান হল পবিত্র কোরআন  জা কোরআনে ১৪০০স বছর আগে বলেছে তা আজ আমাদের বিজ্ঞান  আবিষ্কার করছে
১ – বিজ্ঞান কিছুদিন আগে জেনেছে চাঁদের নিজস্ব কোন আলো নেই। সূরা ফুরক্বানের ৬১ নং আয়াতে কুরআনে এই কথা বলা হয়েছে প্রায় ১৪০০ বছর আগে।
২ – বিজ্ঞান মাত্র দুশো বছর আগে জেনেছে চন্দ্র এবং সূর্য কক্ষ পথে ভেসে চলে… সূরা আম্বিয়া ৩৩ নং আয়াতে কুরআনে এই কথা বলা হয়েছে প্রায় ১৪০০ বছর আগে।
৩ – সূরা কিয়ামাহ’র ৩ ও ৪ নং আয়াতে ১৪০০ বছর আগেই জানানো হয়েছে; মানুষের আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে মানুষকে আলাদা ভাবে সনাক্ত করা সম্ভব। যা আজ প্রমাণিত।
৪ – ‘ বিগ ব্যাং’ থিওরি আবিষ্কার হয় মাত্র চল্লিশ বছর আগে। সূরা আম্বিয়া ৩০ নং আয়াতে কুরআনে এই কথা বলা হয়েছে প্রায় ১৪০০ বছর আগে।
৫ – পানি চক্রের কথা বিজ্ঞান জেনেছে বেশি দিন হয় নি… সূরা যুমার ২১ নং আয়াতে কুরআন এই কথা বলেছে প্রায় ১৪০০ বছর আগে।
৬ – বিজ্ঞান এই সেদিন জেনেছে লবণাক্ত পানি ও মিষ্টি পানি একসাথে মিশ্রিত হয় না। সূরা ফুরকানের ২৫ নং আয়াতে কুরআন এই কথা বলেছে প্রায় ১৪০০ বছর আগে।


৭ – ইসলাম আমাদেরকে ডান দিকে ফিরে ঘুমাতে উৎসাহিত করেছে; বিজ্ঞান এখন বলছে ডান দিকে ফিরে ঘুমালে হার্ট সব থেকে ভাল থাকে।
৮ – বিজ্ঞান এখন আমাদের জানাচ্ছে পিপীলিকা মৃত দেহ কবর দেয়, এদের বাজার পদ্ধতি আছে। কুরআনের সূরা নামল এর ১৭ ও ১৮ নং আয়াতে এই বিষয়ে ধারণা দেয়।
৯ – ইসলাম মদ পানকে হারাম করেছে , চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে মদ পান লিভারের জন্য ক্ষতিকর।
১০ – ইসলাম শুকরের মাংসকে হারাম করেছে। বিজ্ঞান আজ বলছে শুকরের মাংস লিভার, হার্টের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
১১- রক্ত পরিসঞ্চালন এবং দুগ্ধ উৎপাদন এর ব্যাপারে আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞান জেনেছে মাত্র কয়েক বছর আগে। সূরা মুমিনূনের ২১ নং আয়াতে কুরআন এই বিষয়ে বর্ণনা করে গেছে।
১২ – মানুষের জন্ম তত্ব ভ্রুন তত্ব সম্পর্কে বিজ্ঞান জেনেছে এই কদিন আগে। সূরা আলাকে কুরআন এই বিষয়ে জানিয়ে গেছে ১৪০০ বছর আগে।
১৩ – ভ্রন তত্ব নিয়ে বিজ্ঞান আজ জেনেছে পুরুষই ( শিশু ছেলে হবে কিনা মেয়ে হবে) তা নির্ধারণ করে। ভাবা জায়… কুরআন এই কথা জানিয়েছে ১৪০০ বছর আগে।
( সূরা নজমের ৪৫, ৪৬ নং আয়াত, সূরা কিয়ামাহ’র ৩৭- ৩৯ নং আয়াত)
১৪ – একটি শিশু যখন গর্ভে থাকে তখন সে আগে কানে শোনার যোগ্যতা পায় তারপর পায় চোখে দেখার। ভাবা যায়?
১৪০০ বছর আগের এক পৃথিবীতে ভ্রুনের বেড়ে ওঠার স্তর গুলো নিয়ে কুরআন বিস্তর আলোচনা করে। যা আজ প্রমাণিত !
( সূরা সাজদাহ আয়াত নং ৯ , ৭৬ এবং সূরা ইনসান আয়াত নং ২ )
১৫ – পৃথিবী দেখতে কেমন? এক সময় মানুষ মনে করত পৃথিবী লম্বাটে, কেউ ভাবত পৃথিবী চ্যাপ্টা , সমান্তরাল… কোরআন ১৪০০ বছর আগে জানিয়ে গেছে পৃথিবী দেখতে অনেকটা উট পাখির ডিমের মত গোলাকার।
১৬ – পৃথিবীতে রাত এবং দিন বাড়া এবং কমার রহস্য মানুষ জেনেছে দুশ বছর আগে।
সূরা লুকমানের ২৯ নং আয়াতে কুরআন এই কথা জানিয়ে গেছে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে !!
……আমাদের সমস্যা হল আমরা সব কিছুই জানি… যারা নাস্তিক তারাও জানে… পার্থক্য টা হল ‘বোধ’ এর। 

Read More »

শনিবার, ১৫ এপ্রিল, ২০১৭

ইসলাম : একটি ধারণা !

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, আমরা তাঁর প্রশংসা করি এবং আমরা তাঁর সাহায্য চাই এবং তাঁর ক্ষমা চাই। আমরা আমাদের নফসের মন্দ থেকে এবং আমাদের কর্মের মন্দ থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ একমাত্র ইবাদতের যোগ্য এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা এবং সর্বশেষ রাসূল। আল্লাহ শেষ এবং চূড়ান্ত রাসূল মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবার এবং তাঁর অনুসারীদের প্রতি শান্তি ও রহমত বর্ষণ করুন। আমীন!
শুরুতে: সর্বোত্তম উপদেশ হচ্ছে আল্লাহর কিতাব, এবং সর্বোত্তম পথ হচ্ছে মুহাম্মাদের অনুসৃত পথ, এবং দ্বীনের মাঝে নিকৃষ্টতম বস’ হচ্ছে নতুন উদ্ভাবনসমূহ, কারণ দ্বীনে প্রতিটি নব উদ্ভাবন হচ্ছে বিপথগামীতা, প্রতিটি বিপথগামীতা হচ্ছে সরল পথ থেকে বিচ্যুতি, আর প্রতিটি বিচ্যুতির পরিণাম জাহান্নাম।
আমি ‘দি ইকোনমিস্ট’ ম্যাগাজিনের জরিপের বিষয়বস্তু ‘ইসলাম এবং পশ্চিম’ (আগস্ট ৬, ১৯৯৪ সংখ্যা, বড় আকারে সন্নিবেশিত) সম্পর্কে বিশেষভাবে বিবেচনার পর সমালোচনা লিখতে শুরু করেছি, এবং নিঃসন্দেহে আল্লাহ সর্বোত্তম সাহায্যকারী। নোয়াম চমস্কি যাকে “বানানো সম্মতি” বলছেন, ব্রায়ান ব্রিডহ্যামের পক্ষে তার উপর নির্ভর করা সম্ভব। যেক্ষেত্রে একনায়কতন্ত্র লোকের সম্মতি আদায় করতে ও বিরোধিতা ঠেকাতে শক্তি প্রয়োগ করে, সেখানে “গণতন্ত্র” প্রচার মাধ্যমকে বিশেষ বিশ্বব্যবস্থার দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করে সম্মতি তৈরী করতে ব্যবহার করে থাকে। যা কমবেশী শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। ছোট, সংক্ষিপ্ত আকারের একটি প্রবন্ধ লিখে সে পার পেয়ে যেতে পারে, কারণ তাকে তার অধিকাংশ বক্তব্যই প্রমাণ করতে হয় না, তাকে শুধু জোড়া দেওয়া, প্রচলিত মামুলি মন্তব্যসমূহের পুনরাবৃত্তি করতে হয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, যখন তিনি আলজেরীয় মুসলিমদের “একদল ইসলামী বিদ্রোহী যারা আপোষহীনতার বৈশিষ্ট্যসূচক, সবচেয়ে নিষ্ঠুর প্রকৃতির মৌলবাদী” হিসাবে বর্ণনা করেন, তাঁকে সেটা প্রমাণ করতে হয় না, কারণ কর্তৃপক্ষ এটা ইতোমধ্যেই নিশ্চিত করেছে যে এটাই সত্য বলে লোকে বিশ্বাস করবে। আসলে বিবৃতিটি মোটেও সত্য নয়। আলজেরীয় মৌলবাদীরা প্রমাণ করেছে যে তারা নির্বাচন করতে এবং ইসলামী শরীয়া পুনঃপ্রতিষ্ঠার শান্তিপূর্ণ উপায় খুঁজে পেতে ইচ্ছুক। সামপ্রতিক ঘটনাবলী, যেমন রোমে “বিদ্রোহী মৌলবাদী”দের অন্তর্ভুক্ত করে বিরোধী গ্রুপগুলির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে-যা ফরাসী সরকার পর্যন্ত সমর্থন করেছে এবং আলজেরীয় সরকার প্রত্যাখ্যান করেছে-এটাই প্রকাশ করছে যে আলজেরীয় সরকারই বরং নিষ্ঠুর মানসিকতার অধিকারী। এ ধরনের স্পষ্ট প্রতীয়মান অসামঞ্জস্য সত্ত্বেও জনাব ব্রিডহ্যাম কোন জবাবদিহিতার সম্মুখীন হন না, কারণ এই ঐকমত্য আগেই তৈরি হয়ে আছে যে মৌলবাদীরাই বিদ্রোহ পরায়ণ ও নিষ্ঠুর মানসিকতার অধিকারী।



একইভাবে তিনি কখনোই অনুভব করেন না যে তাঁকে প্রমাণ করতে হবে যে গণতন্ত্র একটি সুবিধা, এটা প্রায় সম্পূর্ণ স্বতঃসিদ্ধ হিসেবেই ধরে নেওয়া হয়েছে, কারণ তিনি জানেন যে তাঁর শ্রোতাবৃন্দ বলতে গেলে প্রায় “বন্দী”। আওয়াজের হুল-ফোটানোর (হয়তো এক্ষেত্রে শব্দের হুল-ফোটান) এই যুগে, প্রচলিত জ্ঞানের বিরুদ্ধে যাওয়া সহজ নয়, কারণ জনাব ব্রিডহ্যামের মত লোকেরা যা একটি বাক্যে বলেন, তার বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেলে সেটি একটি বই হয়ে যাবে। তারপরও তার কার্যকারিতায় সন্দেহ থেকে যাবে, কারণ সমাজের মূল্যবোধের বিরোধিতা করা আমাদের মত স্বভাবগত সামাজিক জীবের জন্য অত্যন্ত কঠিন পথের একটি। এজন্য আমি একগুচ্ছ প্রবন্ধ লিখব, একটি নয়, যাতে আমার সমালোচনাটিকে অনেকগুলি সাজানো-গোছানো খণ্ডে ভাগ করা যায়। কিছু বিষয় আমি পরিশিষ্টেও উল্লেখ করবো, যাতে ভিডিও এবং অডিও টেপও অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

ইসলাম : একটি ধারণা!

নিঃসন্দেহে কোন মুসলিম ইসলামকে কেবলমাত্র একটি ধারণা হিসাবে গ্রহণ করতে পারে না। জরিপে যা উল্লেখিত হয়েছে তা হলো, ইসলামের ভিত্তি হচ্ছে “আল্লাহর বাণী, যা চৌদ্দশত বছর আগে প্রতিটি শব্দাংশে মুহাম্মাদের উপর অবতীর্ণ হয়েছিল” (পৃ. ৪, অ. ২)। অর্থাৎ এটা ধারণামাত্র নয়, বরং এটাই ধারণা, এটাই আদর্শ, এটাই সত্য, অন্য সব কিছু বাদে। কুরআন যেমন বলছে:
“নিঃসন্দেহে আল্লাহর কাছে দ্বীন হচ্ছে ইসলাম” … “এবং যে কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মকে জীবন বিধান হিসাবে চাইবে, তা কখনও গ্রহণ করা হবে না এবং আখিরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের দলভুক্ত” (সূরা আলে-ইমরান ৩:৮৫)।
দ্বীনকে সম্পূর্ণ এবং বিশুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে, এবং পরিবর্তন বা খাপ খাওয়ানোর কোন প্রয়োজনীয়তা নেই: “আজ আমরা তোমাদের দ্বীনকে তোমাদের জন্য সম্পূর্ণ করে দিয়েছি এবং আমাদের অনুগ্রহ তোমাদের উপর পরিপূর্ণ করেছি এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসাবে মনোনীত করেছি।” নবী (সঃ) আরো বলেছেন: “ আমি এমন কোন কিছু জানাতে বাদ রাখিনি যা তোমাদের জান্নাতের নিকটবর্তী করবে ও জাহান্নাম থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে, এবং এমন কোন কিছু থেকে সতর্ক করতে বাকী রাখিনি যা তোমাদেরকে জান্নাত থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে ও জাহান্নামের নিকটবর্তী করবে।” এটা নিঃসন্দেহে সত্য যে ইসলাম তার অনুসারীদের জীবনের “আভ্যন্তরীণ” ও “বাহ্যিক” বিশ্বাস এবং কর্ম, ধর্ম ও রাজনীতি এসবের মাঝে পার্থক্য করা অনুমোদন করে না, কারণ বাস্তবে এসব পার্থক্য সম্পূর্ণ প্রতারণামূলক। মানুষের বিশ্বাস হচ্ছে তার কর্মের ভিত্তি ও প্রধান চালিকাশক্তি, কারণ যা কিছু অন্তরে সত্যি বলে মনে করা হয়, বাইরে অবশ্যই তার প্রকাশ ঘটে। কার্যতঃ মুহাম্মাদ (সঃ) কে সর্বপ্রথম যে কাজ দেওয়া হয়েছিল, তা হচ্ছে ভুল বিশ্বাসকে সংশোধন করা। মুশরিক আরবরা যে আল্লাহতে, বা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করত না তা নয়। বস্তুতঃ কুরআন মুহাম্মাদ (সঃ) কে বলছে:
“তুমি যদি তাদের জিজ্ঞাসা কর আকাশ থেকে কে বৃষ্টি বর্ষণ করে? তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ!’ বল: ‘সমস্ত প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা আল্লাহরই!’ না! তাদের অধিকাংশেরই কোন চেতনা নেই।” (সূরা আনকাবুত ২৯:৬৩)
“বল: ‘কে তোমাদের আকাশ ও পৃথিবী থেকে জীবনোপকরণ সরবরাহ করে অথবা শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি কার কর্তৃত্বাধীন? কে মৃত থেকে জীবিতকে নির্গত করে এবং সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে?’ তখন তারা বলবে, ‘আল্লাহ!’ বল: ‘তবুও কি তোমরা সাবধান হবে না’?” (সূরা ইউনুস ১০:৩১)
সত্যি বলতে কি মুশরিক আরবরা প্রয়োজন ও কষ্টের সময় আল্লাহর ইবাদত করত, তাঁর কাছে প্রার্থনা করত এবং কুরবানী করত, ইহুদী ও খৃস্টানদের মত, এবং তারা এমনকি আল্লাহকে ভালবাসার দাবীও করতো, কিন্তু তাদের এ সবকিছুই আল্লাহ প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং তাদেরকে নির্বোধ ও বিপথগামী হিসাবে উল্লেখ করেছেন এবং অবিশ্বাসী বলেছেন। অতএব এটাই অধিকাংশ মানুষ ও জ্বিনের বেলায় বাস্তবতা যে তারা দাবী করে যে তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে ও আল্লাহর ইবাদত করে, কিন’ আল্লাহ সম্পর্কে তারা যা বিশ্বাস করে তা অশুদ্ধ, এবং তাদের ইবাদতের পদ্ধতিও সঠিক নয়…
“তাদের অধিকাংশ আল্লাহতে বিশ্বাস করে কিন’ তাঁর শরীক করে” (সূরা ইউনুস ১২:১০৬)
… এবং এর প্রকাশ বিভিন্ন এবং অশুভ ফলাফল অগণিত।
এসব কিছুরই একটি সাধারণ কারণ বা মূল আছে, তা হচ্ছে কোন জ্ঞান ছাড়া আল্লাহ সম্পর্কে চিন্তা করা ও বলা, এভাবে তাঁর প্রতি এমন কিছু আরোপ করা যা তাঁকে আরোপ করা যায় না, যেমন পুত্র অথবা কন্যা, বা মানবীয় গুণ ও দোষসমূহ, বা এমন দাবী করা যে তাঁর কোন সৃষ্টি তাঁর শক্তি ও সামর্থ ধারণ করে, বা এমন কোন কাজে তিনি ক্রুদ্ধ হন বলে মনে করা যা আসলে তাঁকে সন্তুষ্ট করে। সুতরাং এভাবে মূর্তিপূজারীরা এমন কাউকে ডাকে যে তাদের কোন ভাল বা মন্দ কোনটাই করতে পারে না, এবং খৃস্টানরা যীশুকে ডাকে, এবং ইহুদীরা বিশ্বাস করে তাদের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব তাদেরকে আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য করবে, এবং যারা বিশ্বাস করে যে সাফল্যের উপায় হলো শক্তি, সম্পদ ইত্যাদি ; তারা সকলেই তাদের বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করেছে অসার জিনিসে – এটা নিজেই একটা বিরাট মন্দ, কারণ তারা শুধু তাদের সময় এবং প্রচেষ্টা বিনষ্ট করেছে, যদিও এটাই সবচেয়ে কম খারাপ পরিণতি। সবচেয়ে যা গুরুতর তা হচ্ছে… যারা আল্লাহর সাথে শিরক করে তাঁর ক্রোধ এবং আযাব অর্জন করেছে, এবং তাদের উপর দুনিয়াতেও লাঞ্ছনা রয়েছে আর আখিরাতে ভয়ঙ্কর পরিণতি
“নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে শিরক করার অপরাধ ক্ষমা করেন না। এছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন” (সূরা আন-নিসা ৪:৪৮)।
সুতরাং “শিরক” বা আল্লাহর অংশী স্থাপন করা (তা যেভাবেই হোক না কেন) হচ্ছে ক্ষমার অযোগ্য পাপ, কারণ বাস্তবে এটা সকল অমঙ্গলের মূল, সবচেয়ে বড় অবিচার, নিকৃষ্ট জুলুম এবং কুকাজ। এটা এজন্য যে কেউ যদি আল্লাহ সম্পর্কে না জেনে মন্তব্য করতে দ্বিধা না করে – যে জ্ঞান তাঁর মাধ্যমে ছাড়া অর্জন করা যায় না যেহেতু তিনিই নিজের সম্পর্কে এবং নিজের ইচ্ছা সম্পর্কে এবং কি তাঁকে সন্তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট করে, সে সম্পর্কে সবচেয়ে ভাল জানেন – তাহলে অন্য কার সম্পর্কে কেউ মূর্খের মত কথা বলতে ভয় করবে? সত্যিই, যে প্রকৃতির ধ্বংসকারী শক্তি সম্পর্কে সচেতন, এ দুনিয়ায় ও পরকালে যেসব অকথ্য দুর্ভাগ্য ও দুর্দশা মানুষের জন্য রয়েছে যার উপর আল্লাহ ছাড়া আর কারো কোন শক্তি ও নিয়ন্ত্রণ নেই তা বোঝে, তার কাছে এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান যে আল্লাহই হচ্ছেন সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং ভয়ের যোগ্য। এবং যে কেউ পৃথিবী ও মহাবিশ্বের ভিতরের অলৌকিক শৃঙ্খলা, খুঁটিনাটি ব্যাপারে যথাযথতা ও জীবজগতের পরস্পর নির্ভরশীলতা খেয়াল করে দেখবে, অবশ্যই সে এসবের সৃষ্টিকর্তার অতুলনীয় জ্ঞান ও বিজ্ঞতা অনুধাবন করবে। সুতরাং কেউ যদি আল্লাহর আইন লংঘন করার ব্যাপারে বেপরোয়া হয় এবং সেগুলিকে ক্ষুদ্র বা তুচ্ছ মনে করে অথবা আরো খারাপ ব্যাপার হচ্ছে যদি সেগুলিকে খারাপ, অশুভ এবং বাতিল বলে মনে করে, তাহলে মানুষের সীমাবদ্ধ ধ্যান-ধারণা-উদ্ভূত আইনের বেলায় কি হবে? কেউ যদি তার সৃষ্টিকর্তা ও রিযিকদাতার প্রতি অকৃতজ্ঞ হতে পারে, তাহলে তার কাছে সৃষ্টির প্রতি অকৃতজ্ঞতা কি অত্যন্ত সামান্য ব্যাপার বলে মনে হবে না? আল্লাহর অধিকার ও তাঁর প্রতি কর্তব্যসমূহ, যা সবচেয়ে বেশী পূরণ-যোগ্য, কেউ যদি তা অস্বীকার করে, তাহলে সে আর কোন অধিকার ও দাবী অস্বীকার করতে ভয় করবে? কল্পনা করুন আপনার কোম্পানীর একজন শ্রমিকের কথা, যে আপনাকে মনে করে ঝাড়-দার এবং ঝাড়-দারকে মনে করে কোম্পানীর পরিচালক! সেখানে কি কুফল দেখা দেবে না? আপনি কি এমন লোককে সহ্য করবেন? যদি করেন, কতক্ষণ পর্যন্ত? এখন ভেবে দেখুন এই নির্বোধ অন্যদের বোঝাচ্ছে ও বাধ্য করছে এতে বিশ্বাস করতে, এবং অধিকাংশই আপনার আদেশ ও নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নিজের পছন্দমত নিয়ম তৈরী করছে এবং ঝাড়ুদারকে নিজেদের নেতা মেনে চলছে যে আসলে বধির ও বোবা!



যেসব মন্দ মানুষকে প্রলুব্ধ করে তার আসল কারণ হচ্ছে অবিশ্বাস, পাপপ্রবণতা ও আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞতা:
“তোমাদের যে বিপদাপদ ঘটে তা তোমাদেরই কৃতকর্মের ফল এবং তোমাদের অনেক অপরাধ তিনি ক্ষমা করে দেন” (সূরা আশ-শূরা, ৪২:৩০)
“মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলেস্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে তাদের কোন কোন কর্মের শাস্তি তাদের আস্বাদন করান হয় যাতে তারা সৎপথে ফিরে আসে” (সূরা আর রুম, ৩০:৪১)
যেমন নবী (সঃ) বলেছেন:
“আল্লাহর চেয়ে বেশী মর্যাদা-বোধ সম্পন্ন (গাইরা: কারো সম্মান বা মর্যাদা আহত হলে বা প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হলে যে প্রচণ্ড রাগ ও ক্রোধের অনুভূতি হয়) কেউ নেই, এবং তাই তিনি লজ্জাজনক কাজ ও পাপকাজ নিষেধ করেছেন। এবং আল্লাহর চেয়ে বেশী প্রশংসা পছন্দকারী কেউ নেই” (সহীহ বুখারী)।
কোন মানুষ তার স্ত্রীকে অন্যের সাথে যিনা করতে দেখলে যত না ক্রুদ্ধ হয়, আল্লাহ তার চেয়েও বেশী ক্রুদ্ধ হন তাঁর বান্দার অবাধ্যতায়। তাহলে যারা তাঁর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বী ও অংশীদার স্থাপন করে তাঁকে অপমান করে, যা থেকে তিনি মুক্ত, তাদের প্রতি তাঁর ক্রোধ কতখানি হতে পারে! এবং এর অশুভ পরিণতি এই জীবনে সীমাবদ্ধ নয়:
“নিশ্চয় যারা অবিশ্বাস করেছে এবং অবিশ্বাসী অবস্থায় মারা গেছে, তাদের পক্ষে পৃথিবী-পূর্ণ স্বর্ণ বিনিময় স্বরূপ প্রদান করলেও কখনো তা কবুল করা হবে না। এ সকল লোকের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি এবং এদের কোন সাহায্যকারীও নেই” (সূরা আলে ইমরান, ৩:৯১)।
নবী (সঃ) ব্যাখ্যা করেছেন:
“বিচার দিবসে একজন অবিশ্বাসীকে জিজ্ঞাসা করা হবে: ‘মনে কর তোমার কাছে পৃথিবী-পূর্ণ স্বর্ণ রয়েছে, তুমি কি তা জাহান্নামের আগুনের বদলে মুক্তিপণ হিসাবে দান করবে?’ সে বলবে: ’হ্যাঁ’। তখন তাকে বলা হবে: ‘তোমাদেরকে এর চেয়েও সহজ কিছু করতে বলা হয়েছিল, তা এই যে তোমরা আল্লাহর ইবাদতে কাউকে শরীক করো না এবং আল্লাহর আনুগত্য কর, কিন্তু তোমরা প্রত্যাখ্যান করেছিলে।” (বুখারী)
নিঃসন্দেহে সকল নবীর বক্তব্য/বাণী ছিল এক ও অভিন্ন:
“আল্লাহর উপাসনা করার ও তাগুতকে (সে সমস্ত সত্তা, যাদেরকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার পাশাপাশি ইলাহ বা প্রভু হিসেবে বিবেচনা করা হয়) বর্জন করার নির্দেশ দেবার জন্য আমি অবশ্যই প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল পাঠিয়েছি” (সূরা আন নাহল, ১৬:৩৬)
এবং নিঃসন্দেহে আল্লাহ এজন্যই মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন:
“আমার দাসত্বের জন্যই আমি মানুষ ও জ্বিনকে সৃষ্টি করেছি।” (সূরা আয-যারিয়াত, ৫১:৫৬)
সুতরাং “শিরক” (আল্লাহ সাথে অংশী স্থাপন করা) সেই কারণের বিপরীত যেজন্য আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন, এবং আমাদের অস্তিত্বের উদ্দেশ্যের বিরোধী, যা হচ্ছে আল্লাহকে এককভাবে ইবাদতের জন্য বেছে নেওয়া, সমস্ত মিথ্যা উপাস্যকে ত্যাগ করা, ত্যাগ, দোয়া, আত্মসমর্পণ, অধীনতা, বাধ্যতা ও সম্মতির সাথে এবং ভালবাসা, ভয়, আশা, বিশ্বাস ও আস্থার সাথে সম্পূর্ণভাবে তাঁর ইবাদত করা, শুধুমাত্র তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করা-তাঁর সৃষ্টির প্রশংসা কামনা না করা, এবং সবকিছুই তাঁর শেষ ও চূড়ান্ত রাসূল মুহাম্মাদ (সঃ) এঁর উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে সেই অনুযায়ী করা, এবং নিজের খেয়াল ও প্রবৃত্তি এবং অনুমানবশতঃ না চলা।
এই আলোচনার সাথে প্রাসঙ্গিকতাপূর্ণ হিসাবে আল্লাহর এই সমস্ত গুণাবলী উল্লেখ করা যায় যা শুধু আল্লাহরই বৈশিষ্ট্য এবং তাঁকে এককত্ব দান করে। যেমন হাকিম-বিচারক, হাকীম-বিজ্ঞ, আলীম-সর্বজ্ঞানী এবং শারঈ-বিধানদাতা। আল্লাহ শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তা, নিয়ন্ত্রণকারী ও পালনকর্তা নন, মানবজাতির বিধান দেওয়ার ব্যাপারে এককভাবে জ্ঞান ও বিজ্ঞানসম্পন্ন এবং ভাল-মন্দ, ভুল-শুদ্ধ, হালাল ও হারামের নির্ধারক এবং কোন আইন অনুসারে আমরা বিচার করব, কোন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা আমরা গ্রহণ করব সেসবের নির্ণায়ক…
“তিনি কাকেও নিজ কর্তৃত্বের অংশী করেন না” (সূরা আল-কাহফ, ১৮:২৬)… “বিধান দেবার অধিকার কেবল আল্লাহরই” (সূরা ইউসুফ, ১২:৪০)।
আল্লাহ ইহুদী ও খৃস্টানদের সতর্ক করেছেন এবং তাদেরকে অবিশ্বাসী বলেছেন, কারণ
“…তারা আল্লাহ ব্যতীত তাদের পণ্ডিতগণকে এবং সংসার বিরাগীগণকে তাদের প্রতিপালকরূপে গ্রহণ করেছে” (সূরা আত-তাওবা, ৯:৩১)।
নবী (সঃ) বর্ণনা করেছেন যে তাদের পণ্ডিত ও ধর্মযাজকরা “আল্লাহ যা অবৈধ করেছেন তাকে বৈধ বানিয়েছে আর আল্লাহ যা বৈধ করেছেন, তাকে অবৈধ করেছে এবং লোকেরা তা গ্রহণ করেছে…। সুতরাং এটাই হচ্ছে তাদেরকে লোকেদের ইবাদত করা।” সুতরাং মানুষকে কর্তৃত্বের ক্ষমতা দেওয়া পরিষ্কার ও স্পষ্ট প্রতীয়মান অবিশ্বাস এবং শিরক করা বা আল্লাহর সাথে অংশী স্থাপন করা যা ক্ষমার অযোগ্য পাপ এবং সৃষ্টির উদ্দেশ্যের বিপরীত। যদি আল্লাহ ইহুদী ও খৃষ্টানদের দোষারোপ করে থাকেন তাদের কিতাব ও ঐশী বিধানের জ্ঞানে জ্ঞানী লোকদের কাছ থেকে বিধিবিধান গ্রহণের জন্য যারা সেগুলিকে পরিবর্তন ও বিকৃত করেছিল এবং হারামকে হালাল ও হালালকে হারাম করেছিল, আজ পর্যন্ত তারা যা করে চলেছে, তাহলে তাদের বেলায় কি বলা যাবে যারা এসব বিধিবিধান টম, ডিক, হ্যারী যে কারো কাছ থেকে গ্রহণ করে যাদের কোন কিতাব নেই বা কোন প্রজ্ঞা নেই কেবল অনুমান, খেয়ালখুশী এবং প্রবৃত্তির আকাঙ্খা ছাড়া যেমন গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে?!?
অতএব, ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিনের জরিপটি স্বীকার করছে যে ইসলাম ভিতরে ও বাইরে, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে পার্থক্য করে না, তবু তারা পরামর্শ দিচ্ছে যে মুসলিমরা যেন এটা বর্জন করে, এবং আল্লাহর বিরুদ্ধে নিকৃষ্টতম ভুল, অবাধ্যতা ও বিদ্রোহ করে এবং শিরক করে তাঁর প্রতি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করে। আল্লাহ সত্যি বলেন যখন তিনি বলেন:
“ইহুদী ও খৃষ্টানরা তোমার প্রতি কখনো সন্তুষ্ট হবে না যতক্ষণ না তুমি তাদের ধর্মাদর্শ অনুসরণ কর” (সূরা আল-বাকারা, ২:১২০)
এবং আমরা এ থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাই, তা না হলে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।

Read More »

বুধবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৭

মুহাম্মাদ (সাঃ)-ই একমাত্র শাফা‘আঁতকারী

হযরত আনাস (রা:) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ(সাঃ) এরশাদ করেছেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন মুমিনগণকে (হাশরের ময়দানে স্ব স্ব অপরাধের কারণে) বন্দী রাখা হবে। তাতে তারা অত্যন্ত চিন্তিত ও অস্থির হয়ে পড়বে এবং বলবে, ‘যদি আমরা আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ্‌ তা‘আলার নিকট কারো মাধ্যমে সুপারিশ কামনা করি, যিনি আমাদের বর্তমান অবস্থা থেকে স্বস্তি দিবেন ।’সেই লক্ষ্যে তারা আদম (আঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলবে, ‘আপনি মানবজাতির পিতা আদম, আপনাকে আল্লাহ্‌ নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন, জান্নাতে বসবাস করিয়েছেন, ফেরেশতা মন্ডলীকে দিয়ে আপনাকে সিজদা করিয়েছিলেন এবং তিনিই যাবতীয় বস্তুর নাম আপনাকে শিক্ষা দিয়েছিলেন।আপনি আমাদের জন্য আপনার রবের নিকট সুপারিশ করুন, যেন তিনি আমাদেরকে এই কষ্টদায়ক স্থান হ’তে মুক্ত করে প্রশান্তি দান করেন ।’তখন  আদম  (আঃ)  বলবেন,  ‘আমি  তোমাদের  এই  কাজের মোটেই উপযুক্ত নই’।
নবী করীম (সাঃ) বলেন, তখন তিনি গাছ হ’তে ফল খাওয়ার অপরাধের কথা স্মরণ করবেন, যা হ’তে তাঁকে নিষেধ করা হয়েছিল। [আদম (আঃ) বলবেন] ‘বরং  তোমরা  মানবজাতির  জন্য  আল্লাহ্‌  তা‘আলার  প্রেরিত  সর্বপ্রথম নবী নূহ (আঃ)-এর নিকট যাও’।
তারা নূহ (আঃ)-এর কাছে গেলে  তিনি  তাদেরকে  বলবেন,  ‘আমি  তোমাদের  এ  কাজের  জন্য একেবারেই যোগ্য নই ।’ সাথে সাথে তিনি তাঁর ঐ অপরাধের কথা স্মরণ করবেন, যা অজ্ঞতাবশত: নিজের (অবাধ্য) ছেলেকে পানিতে  না ডুবানোর জন্য আল্লাহ্‌ কাছে প্রার্থনা করেছিলেন। (তিনি বলবেন) ‘বরং তোমরা আল্লাহ্‌ খলীল হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর নিকটে যাও’।
রাসূলুল্লাহ(সাঃ) বলেন, এবার তারা হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর নিকটে যাবে। তখন তিনি বলবেন , ‘আমি তোমাদের এ কাজের জন্য কিছুই করার ক্ষমতা রাখি না ।’ সাথে সাথে তাঁর তিনটি মিথ্যা উক্তির কথা স্মরণ করবেন এবং বলবেন, ‘বরং তোমরা মূসা (আঃ)-এর কাছে যাও। তিনি আল্লাহ্‌র এমন এক  বান্দা,  যাকে  আল্লাহ্‌  তাওরাত  দান  করেছেন,  তার  সাথে বাক্যালাপ করেছেন এবং গোপন কথাবার্তার মাধ্যমে তাঁকে নৈকট্য দান করেছেন’।


রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, তখন তারা সকলে হযরত মূসা (আঃ) এর নিকটে আসলে তিনি বলবেন, ‘আমি তোমাদের জন্য সুপারিশের ক্ষেত্রে অপারগ।’তখন তিনি সেই প্রাণনাশের অপরাধের কথা স্মরণ করবেন, যা তাঁর হাতে সংঘটিত হয়েছিল এবং বলবেন, ‘বরং তোমরা আল্লাহ্‌র বান্দা ও তাঁর মনোনীত রাসূল, তাঁর কালেমা ও রূহ হযরত ঈসা (আঃ)-এর কাছে যাও।’নবী করীম (সাঃ) বলেন, তখন তারা সবাই হযরত ঈসা (আঃ)-এর কাছে গেলে তিনি বলবেন, ‘আমি তোমাদের এ কাজের উপযুক্ত নই।বরং তোমরা মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর কাছে যাও।তিনি আল্লাহ্‌ তা‘আলার এমন এক  বান্দা,  যার  আগের  ও  পরের  সমস্ত  গোনাহ  আল্লাহ্‌  ক্ষমা  করে দিয়েছেন।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘তারা আমার কাছে আসবে।আমি তখন আমার রবের কাছে তাঁর দরবারে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি প্রার্থনা  করব।অতঃপর আমাকে তাঁর নিকট যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে।আমি যখন তাঁকে দেখব, তখনই তাঁর উদ্দেশ্যে সিজদায় পড়ে যাব।আল্লাহ্‌  আমাকে যতক্ষণ চাইবেন সিজদা অবস্থায় রাখবেন’।অতঃপর বলবেন, ‘হে মুহাম্মাদ! মাথা উঠাও।আর যা বলার বল, তোমর কথা শুনা হবে। শাফা‘আত কর, কবুল করা হবে।তুমি চাও, তোমাকে দেওয়া হবে ।’ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘তখন আমি মাথা উঠাব এবং আমার রবের এমনভাবে প্রশংসা বর্ণনা করব, যা তিনি আমাকে শিখিয়ে দিবেন। অতঃপর আমি শাফা‘আত করব। তবে এ ব্যাপারে আমার জন্য একটি সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হবে।তখন আমি আল্লাহ্‌র দরবার হতে উঠে আসব এবং ঐ নির্ধারিত সীমার লোকদেরকে জাহান্নাম হ’তে বের করে জান্নাতে প্রবেশ করাব।তারপর আমি পুনরায় ফিরে এসে আমার প্রতিপালকের দরবারে হাযির হওয়ার জন্য আল্লাহ্‌ কাছে অনুমতি প্রার্থনা করব।আমাকে অনুমতি  দেওয়া হবে।আমি যখন তাঁকে দেখব, তখনই তাঁর উদ্দেশ্যে সিজদায় পড়ে যাব এবং আল্লাহ্‌ যতক্ষণ চাইবেন আমাকে সিজদা অবস্থায় থাকতে দিবেন ।’ তারপর আল্লাহ্‌ বলবেন, ‘হে মুহাম্মাদ! মাথা উঠাও। আর যা বলার বল, তোমার কথা শুনা হবে, সুপারিশ কর, কবুল করা হবে। তুমি প্রার্থনা কর, যা প্রার্থনা করবে তা দেওয়া হবে’।
রাসূল (সাঃ) বলেন, তখন আমি মাথা উঠাব এবং আমার রবের এমনভাবে প্রশংসা ও গুণকীর্তন বর্ণনা  করব, যা আমাকে শিখিয়ে দেওয়া হবে। এরপর আমি শাফা‘আত করব। তবে এ ব্যাপারে আমার জন্য একটি নির্দিষ্ট সীমা বেঁধে দেওয়া হবে। তখন আমি আমার রবের দরবার হ’তে উঠে আসব এবং ঐ নির্দিষ্ট লোকগুলিকে জাহান্নাম হ’তে বের করে জান্নাতে প্রবেশ করাব।অতঃপর তৃতীয়বার ফিরে আসব এবং আমার প্রতিপালক আল্লাহ্‌র দরবারে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করব।আমাকে তাঁর কাছে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে।আমি যখন তাঁকে দেখব, তখনই সিজদায় পড়ে যাব।আল্লাহ্‌ যতক্ষণ ইচ্ছা আমাকে সিজদা অবস্থায় য় রাখবেন ।’ তারপর বলবেন, ‘হে মুহাম্মাদ!  মাথা উঠাও।তুমি যা বলবে তা শুনা হবে, সুপারিশ কর, কবুল করা হবে।প্রার্থনা কর, তা দেওয়া হবে।’রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, ‘তখন আমি মাথা উঠাব এবং আমার রবের এমন হামদ ও ছানা বর্ণনা করব, যা তিনি আমাকে শিখিয়ে দিবেন।’ নবী করীম (সাঃ) বলেন, ‘তারপর আমি শাফা‘আত করব।এ ব্যাপারে আল্লাহ্‌ তা‘আলা আমার জন্য একটি নির্দিষ্ট সীমা বেঁধে দিবেন। তখন আমি সেই দরবার থেকে বের হয়ে আসব এবং তাদেরকে জাহান্নাম হ’তে বের করে জান্নাতে প্রবেশ করাব’।
অবশেষে  কুরআন  যাদেরকে  আটকিয়ে  রাখবে  (অর্থাৎ  যাদের  জন্য কুরআনের ঘোষণা  অনুযায়ী চিরস্থায়ী  ঠিকানা  জাহান্নামে নির্ধারিত  হয়ে গেছে) তারা ব্যতীত আর কেউ জাহান্নামে অবশিষ্ট থাকবে না। বর্ণনাকারী ছাহাবী হযরত আনাস (রা:) বলেন, অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কুরআনের এই আয়াতটি ‘আশা করা যায়, আপনার  প্রতিপালক  অচিরেই  আপনাকে  ‘মাকা‍‌মে মাহমূদে’ পৌঁছিয়ে  দেবেন’ [বনী ইসরাঈল ৭৯] তেলাওয়াত করলেন এবং বললেন, এটাই সেই ‘মাকামে মাহমূদ’ যার প্রতিশ্রুতি তোমাদের নবীকে দেওয়া হয়েছে [ ছহীহ বুখারী হা/৭৪৪০ ‘তাওহীদ’অধ্যায়, অনুচেছদ-২৪, মিশকাত হা/৫৫৭২ ‘কিয়ামতের অবস্থা ও সৃষ্টির সূচনা’অধ্যায়, ‘হাওযে কাওছার ও শাফা‘আত’অনুচেছদ]

শিক্ষা:

১. সকল নবী-রাসলের উপর মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর শ্রেষ্ঠত্ব।
২. রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর শাফা‘আতে পরকালে কিছু জাহান্নামীকে আল্লাহ্‌ জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। এজন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘প্রত্যেক নবীর এমন একটি দো‘আ রয়েছে, যা (আল্লাহ্‌র্ নিকট) গৃহীত হয়, আর নবী সে দো‘আ করে থাকেন।আমার ইচ্ছা, আমি আমার সে দো‘আর অধিকার আখেরাতে আমার উম্মতের শাফা‘আতের জন্য মুলতবি রাখি’  (বুখারী হা/৬৩০৪, ‘দো‘আ সমূহ’অধ্যায়, অনুচেছদ-১)।

৩. কোন পীর-ওলী পরকালে শাফা‘আতের অধিকার রাখবেন না।
Read More »

শনিবার, ২৫ মার্চ, ২০১৭

রোমান সম্রাট হিরাক্লিয়াস এর দরবারে

সপ্তম হিজরি, ৬২৯ খ্রিস্টাব্দ। মক্কার কাফেরদের কুরাইশ দের সাথে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হুদায়বিয়ার সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়েছে। যে ইসলামের নাম শুনলে জ্বলে উঠত কুরাইশদের গা, আজ সেই কুরাইশগণ স্পষ্টত: স্বীকৃতি দিল ইসলামকে একটি শক্তিশালী ধর্ম হিসাবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নদীর মোহনায় এসে তাঁর সাধনার স্রোতধারায় শুনতে পেলেন মহাসাগরের কল্লোল। তাই তিনি মনস্থ করলেন বিশ্বের শক্তিশালী রাজা-বাদশাহদের নিকট ইসলামের সুমহান বার্তা পৌঁছাতে। তৎকালীন বিশ্বের বুকে রোম ও পারস্য ছিল সবচেয়ে ক্ষমতাধর শক্তিশালী সাম্রাজ্য। রোমান সাম্রাজ্যের শাসনকর্তা ছিলেন সম্রাট হিরাক্লিয়াস। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রখ্যাত ছাহাবী দেহিয়া কালবী (রা:)-কে ইসলামের দাওয়াত পত্র তাঁর কাছে প্রেরণ  করেন। সম্রাট হিরাক্লিয়াস  ঐ সময় জেরুজালেমে অবস্থান করছিলেন। এদিকে কুরাইশ নেতা আবূ সুফিয়ান (তখনও  তিনি  মুসলমান  হননি)  ব্যবসা  উপলক্ষে  সিরিয়াতে  অবস্থান  করছিলেন। আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা:) হতে বর্ণিত, তাকে আবূ সুফিয়ান বিন হারব সংবাদ দিয়েছেন যে, একদা রোম সম্রাট হিরাকিলয়াস তাঁকে একদল কুরাইশ সহ ডেকে পাঠালেন। তখন তাঁরা ব্যবসা উপলক্ষে সিরিয়াতে অবস্থান করছিলেন। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আবূ সুফিয়ান ও কুরাইশদের সাথে হুদায়বিয়ার সন্ধি-সূত্রে আবদ্ধ ছিলেন। সম্রাট হিরাকিলয়াস তাঁর অমাত্যবর্গ পরিবৃত অবস্থায় ঈলিয়া বা জেরুজালেমে অবস্থানকালে তাঁরা সম্রাটের দরবারে আগমন করলেন। সম্রাট হিরাকিলয়াস তাঁদেরকে স্বীয় মজলিসে ডেকে নিলেন। তখন তাঁর চতুষপার্শ্বে  ছিলেন রোমান প্রধানগণ। অতঃপর তিনি কুরাইশগণকে এবং তাঁর দোভাষীকে আহবান জানিয়ে বললেন, যে লোকটি তোমাদের মধ্যে নবী বলে দাবী করছেন বংশগতভাবে তোমাদের মধ্যে কে তাঁর অধিক নিকটবর্তী? আবূ সুফিয়ান বললেন, তখন আমি বললাম, ‘বংশগতভাবে আমিই তাঁর নিকটতম ব্যক্তি। সম্রাট  হিরাকিলয়াস নির্দেশ  দিলেন  যে,  তাকে  আমার  নিকটবর্তী  করো  এবং  তাঁর  সঙ্গী- সাথীগণকেও ডেকে এনে তাঁর পেছনে উপস্থিত কর। অতঃপর সম্রাট তার দোভাষীকে বললেন, তুমি তাদেরকে বল, আমি এই লোকটিকে  তাঁর [(রাসূল (সাঃ)] সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করব। যদি সে আমার সাথে কোন মিথ্যা কথা বলে, তবে তোমরা যেন তাকে মিথ্যাবাদী বলে প্রমাণ করো। আবূ সুফিয়ান বলেন,  ‘আল্লাহ্‌র  কসম!  লোকেরা আমার উপর মিথ্যা আরোপ করবে বলে যদি আমার লজ্জার ভয় না হত, তাহলে তখন আমি অবশ্যই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলতাম। সম্রাট সর্বপ্রথম আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, যিনি নবী বলে দাবী করছেন তাঁর বংশ কেমন?
আবূ সুফিয়ান: তিনি আমাদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত বংশগত।
সম্রাট: তাঁর পূর্বে তোমাদের মধ্য হতে কোন ব্যক্তি কখনও এমন কথা বলেছে কি?
আবূ সুফিয়ান: না।
সম্রাট: তাঁর পিতৃপুরুষগণের মধ্যে কেউ বাদশাহ ছিলেন কি?
আবূ সুফিয়ান: না।
সম্রাট: প্রভাবশালী লোকেরা তাঁর অনুসরণ করছে, না দুর্বল লোকেরা?
আবূ সুফিয়ান: দরিদ্র ও দুর্বল শ্রেণীর লোকগুলো।
সম্রাট: তাদের সংখ্যা কি দিন দিন বাড়ছে, না কমছে?
আবূ সুফিয়ান: না, বরং বাড়ছে।
সম্রাট: তাদের মধ্যে কেউ কি সেই দ্বীনে প্রবেশ করার পর তার দ্বীনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে তা ত্যাগ করে থাকে?
আবূ সুফিয়ান: না।
সম্রাট: সে নবুঅত লাভের পূর্বে কি তোমরা তাঁকে মিথ্যাবাদী বলে অপবাদ দিতে?
আবূ সুফিয়ান: না।
সম্রাট: তিনি কখনো কোন অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছেন কি?
আবূ সুফিয়ান: না। তবে আমরা একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য তার সাথে এক সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছি, জানি না এ সময়ের মধ্যে তিনি কি করবেন?
আবূ সুফিয়ান (পরবর্তীতে) বলেন, এই কথাটি ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে অন্য কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি।


সম্রাট: তোমরা কি তাঁর সাথে কোন যুদ্ধ করেছ?
আবূ সুফিয়ান: হ্যাঁ।
সম্রাট: যুদ্ধের ফলাফল কি?
আবূ সুফিয়ান: তাঁর ও আমাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত যুদ্ধের ফলাফল হল বালতিতে পালাক্রমে পানি তোলার ন্যায়। অর্থাৎ কোনটায় তিনি জয় লাভ করেন এবং কোনটায় আমরা।
সম্রাট: তিনি তোমাদেরকে কি নির্দেশ দিয়ে থাকেন?
আবূ সুফিয়ান: তিনি বলেন, তোমরা একমাত্র আল্লাহ্‌র ইবাদত কর। তার সাথে কোন কিছুকে শরীক কোর না। আর তোমরা তোমাদের বাপ-দাদারা যা বলে বেড়াত, তা পরিত্যাগ কর। তিনি আমাদেরকে ছালাত প্রতিষ্ঠা করতে, সর্বদা সত্য কথা বলতে, অশ্লীল ও নিষিদ্ধ কাজ থেকে দূরে থাকতে এবং আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখতে বলেন।
সম্রাট হিরাক্লিয়াস দোভাষীকে বললেন, তুমি তাকে বল, আমি তোমাকে তাঁর বংশ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছি। তুমি উত্তরে বলেছ, তিনি তোমাদের মধ্যে সম্ভ্রান্ত বংশজাত। প্রকৃতপক্ষে নবী-রাসূলগণ তাঁদের কওমের সম্ভ্রান্ত পরিবারে প্রেরিত হয়ে থাকেন। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তোমাদের মধ্যে কেউ কি এ কথা (নবী হওয়ার কথা) বলেছেন? তুমি উত্তরে বলেছ, না। আমি বলতে চাই- যদি তাঁর পূর্বে কেউ এ কথা বলত, তবে অবশ্যই আমি বলতে পারতাম, তিনি এমন এক ব্যক্তি, যিনি পূর্বের কথার পুনরাবৃত্ত করেছেন। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তাঁর পিতৃপুরুষগণের মধ্যে কোন বাদশাহ ছিলেন কি? তুমি উত্তরে বলেছ, না। আমি বলতে চাই- যদি তাঁর পিতৃপুরুষগণের মধ্যে কোন বাদশাহ থাকতে, তাহলে আমি বলতাম, তিনি এমন এক ব্যক্তি, যিনি পিতৃরাজ্য পুনরুদ্ধার করতে ইচ্ছুক। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তোমরা তাঁর নবুঅত লাভের পূর্বে তার প্রতি কোন মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিলে কি? তুমি উত্তরে বলেছ, না। কাজেই আমি বুঝতেছি, তিনি এমন ব্যক্তি নন, যিনি মানুষের ব্যাপারে মিথ্যারোপ করবেন এবং আল্লাহ্‌র উপর মিথ্যারোপ করবেন।আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি যে, প্রভাবশালী লোকেরা তাঁর অনুসরণ করছে, না নিরীহ-দুর্বল লোকগুলো? তুমি উত্তরে বলেছ, নিরীহ-দুর্বল লোকেরাই তাঁর অনুসরণ করছে।আসলে নিরীহ-দুর্বল  লোকেরাই  নবী-রাসূ্ল গণের  অনুসারী  হয়ে  থাকে। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তারা সংখ্যায়  বৃদ্ধি প্রাপ্ত  হচ্ছে, না হ্রাস পাচ্ছে? তুমি উত্তরে বলেছ, বৃদ্ধি হচেছ।ঈমানের ব্যাপারটি পূর্ণতা লাভের সময় পর্যন্ত এরূপই হয়ে থাকে।আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, কেউ তার দ্বীনে প্রবেশ করে বীতশ্রদ্ধ হয়ে আবার সে দ্বীন পরিত্যাগ করেছে কি? তুমি উত্তরে বলেছ,  না। আসলে ঈমানের দীপ্তি ও সজীবতা অন্তরের সাথে মিশে গেলে এরূপই হয়ে থাকে। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তিনি কোন প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন কি? তুমি উত্তরে বলেছ, না। নবী-রাসূ্ল গণ এরূপই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি, তিনি তোমাদেরকে কি নির্দেশ প্রদান করেন? তুমি উত্তরে বলেছ, তিনি তোমাদেরকে একমাত্র আল্লাহ্‌র ইবাদত করার ও তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক না করার নির্দেশ প্রদান করেন। তিনি তোমাদেরকে মূর্তিপূজা করতে নিষেধ করেন এবং তোমাদেরকে ছালাত প্রতিষ্ঠা করার, সত্য কথা বলার ও পূত-পবিত্র থাকার নির্দেশ প্রদান করেন। তুমি যা বলেছ তা যদি সত্য হয়, তবে তিনি অত্যন্ত অল্পকালের  মধ্যেই  আমার  এ  পদদ্বয়ের  নিম্নবর্তী  স্থানের  (সিরিয়ার) মালিক হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করবেন। আমি নিশ্চিত জানতাম, তার আবির্ভাব হবে; কিন্তু তিনি যে তোমাদের মধ্য হতে হবেন, একথা ভাবতে পারিনি। আমি যদি যথাযথভাবে তাঁর নিকট পৌছাতে পারব বলে জানতে পারতাম, তাহলে আমি তাঁর সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে সম্ভাব্য সর্ব প্রকার কষ্ট স্বীকার করতাম। আর আমি যদি তাঁর নিকট থাকতাম, তাহলে অবশ্যই আমি তাঁর পা ধুয়ে দিতাম। অতঃপর সম্রাট হিরাক্লিয়াস রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পত্রখানা আনতে বললেন, যে পত্রখানা দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ছাহাবী দেহিয়া কালবী (রা:)-কে বছরার শাসনকর্তার নিকট পাঠিয়েছিলেন। বছরার অধিপতি হারেছ পত্রখানা সম্রাট হিরাকিলয়াসকে প্রদান করলে তিনি তা পাঠ করলেন। পত্রটি ছিল নিন্ম রূপ-
‘পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহ্‌র নামে শুরু করছি। আল্লাহ্‌র বান্দা ও তদীয় রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ হতে রোম সম্রাট হিরাকিলয়াসের প্রতি। যারা সঠিক পথের অনুসারী, তাঁদের উপর শান্তি বর্ষিত হৌক। অতঃপর, আমি আপনাকে ইসলামের দাওয়াত প্রদান করছি। ইসলাম গ্রহণ করুন, নিরাপদে থাকতে পারবেন। আল্লাহ্‌ আপনাকে দ্বিগুণ পুরস্কারে ভূষিত করবেন। আর যদি মুখ ফিরিয়ে নেন, তাহলে সকল প্রজার পাপ আপনার উপর বর্তাবে। ‘হে আহলে কিতাব! ‘তোমরা একটি কথার দিকে চলে আস, যে কথাটি আমাদের ও তোমাদের মধ্যে অভিন্ন, আমরা যেন আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত না করি, তাঁর সাথে অন্য কোন কিছুকে শরীক না করি এবং আমাদের কেউ যেন আল্লাহ্‌ ছাড়া অপর কাউকে প্রভু হিসাবে গ্রহণ না করি। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তাদের বলে দাও, তোমরা সাক্ষী থাক যে, আমরা মুসলিম’ (আলে ইমরান ৬৪) ।
আবূ সুফিয়ান বলেন, যখন সম্রাট হিরাক্লিয়াস তাঁর বক্তব্য ও পত্রখানা পাঠ শেষ করলেন, তখন তাঁর সম্মুখে শোরগোল ও চীৎকার চরম আকার ধারণ করল এবং আমাদেরকে বের করে দেয়া হল। তখন আমি আমার সঙ্গী-সাথীদেরকে বললাম, আবূ কাবশার  (মুহাম্মাদ)  ছেলের  বিষয়  তো শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, বনু আছফার (রোম)-এর বাদশাহও তাকে ভয় পাচ্ছে। তখন থেকে আমি বিশ্বাস করতাম যে, তিনি শীঘ্রই জয়ী হবেন। অবশেষে মহান আল্লাহ্‌ আমাকে ইসলাম গ্রহণের তাওফীক্ব দিলেন (ছহীহ বুখারী হা/৭, ‘অহির সূচনা’অধ্যায়, অনুচেছদ-৬, মুসলিম হা/১৭৭৩, মিশকাত হা/৫৮৬১)।

শিক্ষা:

১. গরীব-অসহায়রাই দ্বীনী কাজে অগ্রগামী থাকে।
২. আল্লাহ্‌ রাববুল আলামীন প্রত্যেক মানুষকে সত্য-মিথ্যা ও ভাল-মন্দ বুঝার অনুধাবন শক্তি দিয়েছেন।

৩. ক্ষমতা লিপ্সা ও স্বার্থ হানির ভয়ে মানুষ হক গ্রহণ থেকে বিরত থাকে।
Read More »